প্রকৃতির রূপে ঝলমলে অরুণাচল

লিয়াকত হোসেন খোকন

আসাম রাজ্যের উত্তরে অরুণাচল প্রদেশের অবকাশস্থান। অরণ্যপ্রধান, জনবিরল এবং বিভিন্ন উপজাতীয় মানুষদের বাসভূমি অরুণাচলে দু'দশক আগেও পর্যটকদের উপস্থিতি ছিল নগণ্য। পথ-ঘাট এবং পরিবহন ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতির ফলে ক্রমশ ভ্রমণরসিকদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে পর্যটকমহলে অরুণাচল ভ্রমণ নিয়ে উৎসাহ এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে পর্যটন মরসুমে, বিশেষ করে পুজোর সময়, অনেক আগে থেকে হোটেলের ঘর বুক না করলে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়।
বিশাল আয়তনবিশিষ্ট অরুণাচলে দর্শনীয় স্থানের সংখ্যা কম নয়। একজন পর্যটকের দৃষ্টিতে রাজ্যটিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। পূর্ব অরুণাচল, মধ্য অরুণাচল এবং পশ্চিম অরুণাচল। পশ্চিম অরুণাচলেই পর্যটকদের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি, কারণ এখানেই রয়েছে বমডিলা, দিরাং, সেলাপাস এবং সুন্দর শহর তাওয়াং। তাছাড়া গৌহাটি থেকে তেজপুর হয়ে এইসব জায়গা সহজেই ঘুরে আসা যায়। গভীর জঙ্গল, নয়নাভিরাম নদী উপত্যকা এবং বেশকিছু উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর দর্শন মেলে মধ্য অরুণাচলে।

বমডিলা ঃ
গৌহাটি থেকে পশ্চিম কামেং জেলার সদর বমডিলার দূরত্ব ৩৪২ কিলোমিটার। গৌহাটি থেকে সুপারফাস্ট বাসে চেপে সরাসরি যাওয়া যায়, আবার ইচ্ছে করলে তেজপুরে একটি রাত কাটিয়ে পরদিন গাড়ি ভাড়া করে বা শেয়ারের সুমোয় চেপে পৌঁছে যাওয়া যায় তেজপুর থেকে ১৬১ কিলোমিটার দূরবর্তী বমডিলায়। ছয়-সাতজনের দল হলে গাড়ি ভাড়া করে বমডিলা, দিরাং, তাওয়াং বেড়িয়ে আসাই সুবিধেজনক। গাড়ি ভাড়া করলে চলার পথের দ্রষ্টব্যগুলো দেখে নেওয়া যায়; যেমন টিপি অর্কিড হাউস, সেলা টপ, যশবন্ত সিংয়ের স্মৃতিমন্দির, জং জলপ্রপাত ইত্যাদি।
ভালুক়ংম্প  চেকপোস্ট দিয়ে অরুণাচলে প্রবেশ করার পর ৫ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করলেই গাড়ি দাঁড়াবে টিপি অর্কিড রিসার্স সেন্টারের সামনে। এখানে নানান প্রজাতির অর্কিডের দর্শন পাওয়া যাবে। অর্কিড ছাড়া এখানে স্থান পেয়েছে বেশ কিছু বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ, গুল্ম, লতা এবং গাছপালা। টিপি ছাড়িয়ে গাড়ি চড়াইপথ ধরে ক্রমশ আরও উঁচুতে উঠতে আরম্ভ করবে। চোখে পড়বে জঙ্গলাকীর্ণ একের পর এক পাহাড়। পথসংলগ্ন রাক্ষুসে ফার্ন, বিশালাকার বাঁশগাছ আর বুনো কলাগাছ দেখে অবাক হতে হবে। মাঝে মাঝেই ঘন কুয়াশায় ঢেকে যাবে চলার পথ, আকাশ মেঘা"ছন্ন হয়ে শুরু হবে টিপটিপ করে বৃষ্টি। কিছুদূর যাওয়ার পর যেন মন্ত্রবলে মেঘ-কুয়াশা উধাও হয়ে যাবে, চোখে পড়বে নীল আকাশের নিচে রোদে ঝলমল করছে অরুণাচলের পার্বত্যভূমি।

একসময় গাড়ি পৌঁছবে 'জিরো পয়েন্ট'। পথ এখানে দু-ভাগ হয়েছে। সোজা পথটি গিয়েছে বমডিলা আর ডান দিকের পথটি গিয়েছে পূর্ব কামেং জেলার সদর সেল্পা শহরে। জিরো পয়েন্টের পর নাগমন্দির রাপা এবং টেঙ্গা ভ্যালি হয়ে পথ পৌঁছে যাবে ৮,২০০ ফুট উ"চতায় অবস্থিত শৈলশহর বমডিলায়। পশ্চিম অরুণাচলের গুরুত্বপূর্ণ শহর বমডিলা। ১৯৬২ সালে শহরটিকে কিছুদিনের জন্য চীন অধিকার করে নেয়।
বমডিলা শহরের আবহাওয়া সদা পরিবর্তনশীল। সকালের দিকে আকাশ পরিষ্কার থাকলেও একটু বেলা হলেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এরপর সারা দিন ধরে চলতে থাকে মেঘ-রৌদ্রের লুকোচুরি খেলা।
বমডিলা শহরের প্রধান দ্রষ্টব্য হলো দুটি বৌদ্ধ গুম্ফা। একটি প্রাচীন, অপরটি নবীন। প্রাচীন গুম্ফাটির অবস্থান ঘনবসতিপূর্ণ বাজার এলাকায়। লোয়ার মনাস্ট্রি নামে এটি পরিচিত। বুদ্ধমন্দিরের ভেতরের পরিবেশ মনকে প্রভাবিত করে। তিব্বতি ঢাকের শব্দ, শিঙাধ্বনির সঙ্গে লামাদের ছন্দোবদ্ধ মন্ত্রপাঠ শুনতে শুনতে এক অদ্ভুত অনুভূতিতে চেতনা আ"ছন্ন হয়।

লোয়ার মনাস্ট্রির অদূরেই রয়েছে ক্র্যাফট সেন্টার। পশ্চিম ও পূর্ব কামেং জেলার অধিবাসী মনপা, শেরদুকপেন, আকা এবং মিজি উপজাতীয় শিল্প-কারিগরদের তৈরি বিভিন্ন হস্তশিল্প সামগ্রী এবং কলাকৃতির নির্দশন এখানে প্রদর্শিত হয়েছে।
অরুণাচলের রমণীরা ঃ
বমডিলার আরেকটি দ্রষ্টব্য হলো লোকসংস্কৃতি মিউজিয়াম। এখানে অরুণাচলের বিভিন্ন উপজাতীয় মানুষজনের জীবনযাত্রা, সাংস্কৃতিক জীবন, উৎসব এবং অন্যান্য বিষয়কে দর্শকদের সামনে সুপরিকল্পিতভাবে উপস্থিত করা হয়েছে।
বমডিলার নতুন গুম্ফাটির অবস্থান বমডিলা শহরের একেবারে ওপরে। পায়ে হেঁটে বা গাড়িতে এই আপার মনাস্ট্রিতে গিয়ে গুম্ফার চত্বরে দাঁড়ালে বমডিলা শহর এবং আশপাশের অনেকটা এলাকা দৃষ্টিগোচর হবে। এই গুম্ফাতে একটি আবাসিক বিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে লামাদের দ্বারা।
দিরাং ঃ 
বমডিলা থেকে তাওয়াংগামী ১৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথটি গিয়েছে দিরাং নামে ছোট্ট শহরের ওপর দিয়ে। বমডিলা থেকে বেশ কিছুটা উতরাই পথে নামার পর গাড়ি চলবে নদীর ধার দিয়ে। ভারি নয়নমুগ্ধকর এই যাত্রাপথ। বমডিলা থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরবর্তী ৫,৫০০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট দিরাং শহরের প্রাকৃতিক শোভা অনবদ্য। দিরাং থেকে সাংতি উপত্যকায় অবস্হিত সাংতি গ্রামের দূরত্ব প্রায় ১১ কিলোমিটার। সঙ্গে গাড়ি থাকলে অবশ্যই সেখানে যাওয়া উচিত। দিরাং এবং সাংতি উপত্যকার উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্যগুলো হলো ভেড়া প্রজননকেন্দ্র, ইয়াক রিসার্চ সেন্টার, আপেল, নাশপাতি, চেরি প্রভৃতি ফলের বাগান এবং উষ্ণ প্রস্রবণ।
তাওয়াং ঃ
দিরাং থেকে তাওয়াং যাওয়ার পথে অতিক্রম করতে হবে বিখ্যাত সেলা পাস (উচ্চতা ১৩,৭২১ ফুট), দিরাং শহর থেকে যার দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। আবহাওয়া ভালো থাকলে সেলা টপে অবস্হিত শিবমন্দিরটি দেখে নেওয়া যাবে। সেলা গিরিপথ অতিক্রম করার পর পথের বাঁ দিকে চোখে পড়বে সেলা লেক।
উতরাই পথ ধরে নামার সময় পথে পড়বে যশবন্তগড়, যেখানে রয়েছে বীর সৈনিক যশবন্ত সিং রাওয়াতের স্মৃতিমন্দির। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে রাইফেলম্যান যশবন্ত সিং নিজের প্রাণের বিনিময়ে এই এলাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সেনা চৌকি দীর্ঘ সময় ধরে আগলে রেখেছিলেন, যার ফলে চীনা সৈনিকদের অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। যশবন্তগড় থেকে উতরাই পথ ধরে আবার পথচলা। উতরাই পথ শেষ হবে জং নামের জনপদে পৌঁছে। জং গ্রামের অনতিদূরেই রয়েছে এক অনিন্দ্যসুন্দর জলপ্রপাত।
১০,২০০ ফুট উচ্চতায় তাওয়াং এমনই এক বিশিষ্ট শৈলশহর যার তুলনা অন্য কোনো পাহাড়ি শহরের সঙ্গে করা যাবে না। শহরের উত্তর দিকে উত্তুঙ্গ পর্বতমালা আর দক্ষিণে গভীর নদী উপত্যকা।
তাওয়াং শহরের প্রধান আকর্ষণ হলো ৪০০ বছরের প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ বা 'তাওয়াং মনাস্ট্রি' নামে বিখ্যাত। প্রায় ৫০০ লামা এখানে বাস করেন। মাঠের প্রধান মন্দিরে রয়েছে প্রায় ২৬ ফুট উঁচু বুদ্ধমূর্তি। এক দশক আগে তাওয়াং মঠে একটি সংগ্রহশালা স্থাপিত হয়েছে। এই মিউজিয়ামে প্রদর্শিত সামগ্রীগুলো বৈচিত্র্যে এবং ঐতিহাসিক মূল্যে অসাধারণ। এখানে দেখা যাবে প্রাচীন পুঁথি, থাংকা, চার-পাঁচশো বছরের পুরনো বাসনপত্র, ধাতুনির্মিত বুদ্ধ এবং বৌদ্ধ ধর্মগুরুদের মূর্তি, কাঠের মুখোশ, বাদ্যযন্ত্র, অস্ত্রশস্ত্র, দুটি বিশাল আকারের গজদন্ত এবং আরও নানান সামগ্রী।
তাওয়াং বৌদ্ধ মঠ দুটি ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। এখানে যষ্ঠ দালাই লামা জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দ্বিতীয় ঘটনাটি তুলনায় সাম্প্রতিক। চতুর্দশ দালাই লামা লাসা থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেন ১৯৫৯ সালের ১৭ মার্চ এবং দীর্ঘ পথ গোপনে অতিক্রম করে তাওয়াং মঠে এসে উপস্থিত  হন মার্চ মাচের ৩০ তারিখে।
তাওয়াং মঠের চত্বর থেকে তাওয়াং শহর এবং দূরের নদী উপত্যকার শোভা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।
তাওয়াং মঠের অদূরেই রয়েছে বৌদ্ধ ভিক্ষুণীদের মঠ আন্নি গুম্ফা। পুরুষ দর্শনার্থীরাও এই গুম্ফায় যেতে পারেন।
তাওয়াং শহরের অন্যান্য দ্রষ্টব্য হলো ওয়ার মেমোরিয়াল, ক্রাফট সেন্টার এবং রাজ্য সরকারের সেলস এম্পোরিয়াম।
তাওয়াং থেকে গাড়ি ভাড়া করে ঘুরে আসা যায় পিটিসো লেক (১৬ কিলোমিটার) এবং সাঙ্গেস্টার লেক (৪২ কিলোমিটার)। তাওয়াং থেকে সেনাবাহিনীর অনুমতি সংগ্রহ করে ঘুরে আসা যায় বুমলা। এই জায়গাটি ভারত-চীন সীমান্তে অবস্থিত।
ইটানগর ঃ 
আসামের তেজপুর শহরকে বলা হয় পশ্চিম ও মধ্য অরুণাচল ভ্রমণের 'বেস ক্যাম্প'। গৌহাটি থেকে সরাসরি ইটারগর যাওয়ার বাস সার্ভিস থাকলেও গৌহাটি থেকে তেজপুর গিয়ে সেখানে এক রাত্রি কাটিয়ে পরদিন বাসে, গাড়ি ভাড়া করে বা শেয়ারের সুমোতে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যাবে ২১৬ কিলোমিটার দূরবর্তী অরুণাচলের রাজধানী শহর ইটানগরে।
তেজপুর থেকে ইটানগর যাওয়ার পথটি ব্রহ্মপুত্রের উত্তর তীরবর্তী ৫২ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে ১৮৬ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করার পর পৌঁছে গিয়েছে বান্দরদেওয়া নামের জায়গায়। এখানে পথ দু-ভাগ হয়েছে। সোজা পথটি চলে গিয়েছে উত্তর লখিমপুর শহরের দিকে আর বাঁ দিকের পথটি গিয়েছে ২০ কিলোমিটার দূরবর্তী নাহারলাগুন আর ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্হিত ইটানগর শহরে। বান্দরদেওয়া চেকপোস্টে ইনারলাইন পারমিট দেখাবার পর নাহারলাগুনের দিকে এগিয়ে যাওয়ায় অনুমতি মেলে। নাহারলাগুন আর ইন্টানগরকে নিয়েই অরুণাচলের রাজধানী গড়ে উঠেছে। রাজ্য সরকারের বেশির ভাগ দপ্তর নাহারলাগুনে অবস্থিত।
প্রথম দর্শনেই বোঝা যায়, ইটানগর শহরটির বয়স বেশি নয়। ইটানগরের আদি ইতিহাস অবশ্য বেশ প্রাচীন। বর্তমান শহরের কাছেই জিতারি বংশের শেষ রাজা রামচন্দ্রের রাজধানী মায়াপুর। সাতশো বছর আগে ইটের তৈরি বিশাল দুর্গের ভগ্নাবশেষ থেকে উদ্ধার করা বেশি কিছু নিদর্শন রক্ষিত আছে ইটানগরের জওহরলাল নেহরু স্টেট মিউজিয়ামে।
ইটানগরে দর্শনীয় স্থানের সংখ্যা বেশি নয়। এদের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে স্টেট মিউজিয়ামের নাম। অরুণাচলের প্রতিটি উল্লেখ্যযোগ্য উপজাতি গোষ্ঠীকে মাটি এবং প্লাস্টার অব প্যারিসের তৈরি মডেলের সাহায্যে দর্শকদের সামনে উপস্হিত করা হয়েছে। তাদের জীবনযাত্রার বৈশিষ্ট্যগুলো খুব যতেœর সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া উপজাতীয় মানুষদের দক্ষ হাতে তৈরি বেত, কাঠ এবং বাঁশের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রীর এক অসাধারণ সংগ্রহ দেখে তাক লেগে যায়। মিউজিয়াম সোমবার বন্ধ থাকে।
মিউজিয়ামের অদূরে, ছোট্ট এক টিলার ওপর রয়েছে বৌদ্ধ মন্দির। গাছপালায় ঘেরা মন্দিরের পরিবেশ ভারি মনোরম। ইটানগরের অন্যান্য দ্রষ্টব্য হলো বোটানিক্যাল গার্ডেন, রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির, ক্র্যাফ্ট সেন্টার, ইন্দিরা গান্ধী পার্ক, মিনি জু, এনার্জি পার্ক এবং পোলো পার্ক। শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে আছে গঙ্গা লেক। জলবিহারে আগ্রহীদের জন্য এখানে বোটিংয়ের ব্যবস্থা আছে। গঙ্গা লেক যাওয়ার পথেই পড়বে অর্কিড রিসার্চ সেন্টার।
ইটানগরে উপজাতীয় মানুষজনের সংখ্যা বেশ কম। যাদের দেখা পাওয়া যাবে তারা প্রায় সবাই নিশি উপজাতির মানুষ। নিশি উপজাতির পুরুষদের মাথায় ঝুঁটি দেখেই চেনা যাবে। মাথায় সামনের অংশে অবস্হিত চুলের ঝুঁটিতে শজারুর কাঁটা গোঁজা থাকে। নিশি রমণীদের পোশাক-পরিচ্ছেদ এবং অলংকারের বৈচিত্র্য দেখেও অবাক হতে হবে।
হাপোলি-জিরো ঃ
ইটানগর থেকে গাড়ি ভাড়া করে বা শেয়ারের সুমোয় ১৬৭ কিলোমিটার দূরের হাপোলি শহরে যেতে হলে আবার সেই বান্দরদেওয়া চেকপোস্ট দিয়ে নর্থ লখিমপুরগামী জাতীয় সড়কে ফিরে আসতে হবে। নর্থ লখিমপুর পৌঁছবার ১৬ কিলোমিটার আগে পথ দু-ভাগ হয়েছে। জাতীয় সড়ক থেকে বেরিয়ে একটি রাস্তা সোজা উত্তর দিকে চলে গিয়েছে। এই পথ ধরে ১৮ কিলোমিটার গেলে গাড়ি পৌঁছবে অরুণাচলের অন্যতম প্রবেশদ্বার কিমিন চেকপোস্টে। এখানে ইনারলাইন পারমিট দেখাতে হবে। কিমিন চেকপোস্টকে পেছনে ফেলে রেখে কিছুদূর গেলেই চড়াই পথের শুরু। এই পথে কিছুটা দূরত্ব অতিক্রম করার পর গাড়ি পৌঁছবে এক প্রশস্ত উপত্যকায়। চোখে পড়বে উপজাতিদের ছোট ছোট গ্রাম। এই এলাকায় প্রচুর কমলালেবুর বাগান আছে। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে দেখা যাবে পথের ধারেই কমলালেবু বিক্রি হচ্ছে। জায়গাটির নাম 'হাওয়া ক্যাম্প'। পাহাড়ি পথ ধরে এগিয়ে চলার পথে পেরিয়ে যেতে হবে ছোট-বড় বিভিন্ন জনপদ, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাম হলো প্রোটিন, পুসা, হয়াজালি এবং হয়াচুলি। এর পরই অতিক্রম করতে হবে জেরম টপ (উ"চতা ৫,৭৫৪ ফুট)। জেরম টপ এক অসাধারণ ভিউ পয়েন্ট। এখান থেকে অরুণাচলের আরণ্যক শোভা দেখে মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। জেরম টপ থেকে হাপোলি শহরও দৃষ্টিগোচর হয়।
জেরম টপ অতিক্রম করার পর উতরাই পথ ধরে হাপোলি শহরে পৌঁছতে সময় লাগবে আধঘণ্টা। ইটানগর থেকে হাপোলি যাওয়ার নতুন একটি পথ চালু হয়েছে। এই পথটি গিয়েছে দুই মুখ হয়ে। রাস্তার অবস্থা কিছু কিছু জায়গায় বেশ খারাপ হলেও এই পথটি গিয়েছে গভীর জঙ্গল ভেদ করে, আদিম এলাকার ওপর দিয়ে। এই পথেও শেয়ারের টাটা সুমো চলাচল করে।
হাপোলি এবং জিরোকে যমজ শহর বললে ভুল হবে না। হাপোলি থেকে জিরো মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে। যদিও জিরো হলো লোয়ার সুবনসিরি জেলার সদর শহর, জিরোর থেকে বড় শহর হলো হাপোলি। প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত এই অঞ্চলটি হলো আপাতানি উপজাতির বাসভূমি। অরুণাচলের ২৬টি প্রধান উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে আপাতানিরা এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। কৃষিকাজ, পশুপালন এবং মাছ চাষে এরা অত্যন্ত দক্ষ। প্রাকৃতিক শক্তিকে এরা ভয়-ভক্তি করে। এদের উপাস্য হলো সূর্য এবং চন্দ্র, যাঁরা দোয়নিপেলোরূপে পূজিত। আপাতানি মহিলাদের কপালে আর চিবুকে উল্কি, গলাভর্তি রঙিন পাথরের মালা আর নাকে বেত বা কাঠের তৈরি নাকছাবি। এরা তাঁত চালাতেও বেশ পটু। আপাতানি ছাড়া লোয়ার সুবনসিরি জেলার অন্যান্য কয়েকটি উপজাতি হলো দাফলা, হিলমিরি, মিশমি, বাংনি, মিজি, নিশি এবং সুলুং।
হাপোলি শহরে গ্রাম থেকে আসা আপাতানি নারী-পুরুষদের দর্শন পাওয়া যাবে হাপোলি বাজারের ভেতরে। হাপোলি থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্হিত তারিন ফিশ ফার্ম ঘুরে আসা যায়, ভালো অভিজ্ঞতা হবে। হাপোলি থেকে কিছুক্ষণ পরপরই ছোট বাস যাচ্ছে জিরো শহরে। পথের শোভা দেখতে দেখতেই হঠাৎ খেয়াল হবে বাস পৌঁছে গিয়েছে জিরো।
পাহাড়ে ঘেরা এক বিস্তৃত সমতল ভূখণ্ডে জিরো শহর গড়ে উঠেছে। শহরের নজরকাড়া জায়গাটি হলো জিরো বিমানঘাঁটি। এককালে ছোট বিমান চলাচল করত, এখন শুধু হেলিকপ্টার ওঠানাম করে। জিরো শহরকে ঘিরে রেখেছে ছোট-বড় আপাতানি গ্রাম। যেকোনো গ্রামে গেলেই মিলবে আন্তরিক অভ্যর্থনা। উপজাতীয় সমাজের জীবনযাত্রাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে। সব মিলিয়ে হাপোলি এবং জিরো ভ্রমণ এক ভিন্ন স্বাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। জিরো থেকে ঘুরে আসা যায় তালে উপত্যকা ও অভয়ারণ্য থেকে, দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার।
দাপোরিজো ঃ
জিরো থেকে আপার সুবনসিরি জেলার সদর শহর দাপোরিজোর দূরত্ব ১৮০ কিলোমিটার। গাড়ি ভাড়া করে বা শেয়ারের টাটা সুমোয় সহজেই যাওয়া যায়, এই পথে বাসের ওপর নির্ভর না করাই ভালো।
জিরো থেকে দাপোরিজো যাওয়ার পথটি বৈচিত্র্য এবং রোমাঞ্চে ভরা। মাঝে মাঝেই পথ গিয়েছে আদিম অরণ্যের ভেতর দিয়ে। চোখে পড়তে পারে পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা বিশালদেহী প্রাণী মিথুন। চেহারা দেখে ভয় লাগলেও অতি নিরীহ এই তৃণভোজী প্রাণী। অনেকটা গাউর বা ভারতীয় বাইসনের মতো দেখতে মিথুন অর্ধ-গৃহপালিত জীব বলা চলে। গ্রামের কাছেপিটের জঙ্গলে এরা স্বাধীনভাবে বিচরণ করে বটে কিন্তু প্রত্যেকটি মিথুনের মালিকানা নির্দিষ্ট। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মিথুন বলি দিয়ে তার মাংস আত্মীয় এবং গ্রামবাসীদের মধ্যে বিতরণ করা এক চিরাচরিত প্রথা।
জিরো থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার পর একসময় চোখে পড়বে সুবনসিরি নদী উপত্যকার একধারে গড়ে ওঠা দাপোরিজো শহর। প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে যাবে ছোট্ট এই শহরটিকে। জেলা শহর হওয়ার সুবাদে এখানে গড়ে উঠেছে অফিস-কাছারি, পাকা ঘরবাড়ি, বাজার-হাট, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, হোটেল, মিউজিয়াম, হস্তশিল্পকেন্দ্র এবং আরও কত কি। দাপোরিজো শহরে বহিরাগত চাকরিজীবী এবং ব্যবসায়ীদের সংখ্যা কম নয়। আপার সুবনসিরি জেলার প্রকৃত রূপ দেখতে হলে দাপোরিজো থেকে বাইরে পা রাখতে হবে। এই অঞ্চলের প্রধান দুটি উপজাতি হলো তাগিন এবং হিলমিরি। এদের কাছ থেকে দেখতে হলে স্থানীয় কাউকে সঙ্গী করে পৌঁছে যেতে হবে কোনো উপজাতি গ্রামে। চলার পথে চোখে পড়বে অচেনা গাছপালা, লতা-গুল্ম, প্রাচীন বনস্পতি আর সুবনসিরি উপত্যকার অপরূপ বিস্তার। গ্রামে গিয়ে পৌঁছবার কিছুক্ষণ পরই মনে হবে এ এক অচেনা জগৎ। গ্রামবাসী উপজাতি মানুষদের পোশাক-পরিচ্ছদ, অলংকার এবং তাদের সহজ-সরল জীবনযাত্রা দেখে এক অদ্ভুত ভালো লাগায় মন ভরে যাবে।
দাপোরিজো থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরবর্তী মেঙ্গাতে রয়েছে এক প্রাকৃতিক গুহা। হিন্দু ভক্তরা এখানে মহাদেব এবং আরও কয়েকজন দেব-দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেছে। একটু কষ্ট করে গুহার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাগমাইটের বিচিত্র জগৎ।
আলং ঃ
দাপোরিজোর পর পরবর্তী গন্তব্য হলো পশ্চিম সিয়াং জেলার সদর আলং, দাপোরিজো থেকে দূরত্ব ১৭৮ কিলোমিটার। যাওয়ার জন্য ভাড়ার গাড়ি এবং শেয়ারের সুমোর ওপর নির্ভর করাই ভালো। অরুণাচলের পশ্চিম সিয়াং জেলা হলো প্রধানত আদি উপজাতি মানুষদের বাসভূমি। শিক্ষা, আর্থিক স"ছলতা এবং জীবনযাত্রার মানে আদি উপজাতি মানুষেরা অন্যদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে। অরুণাচল সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আদিদের আধিপত্য চোখে পড়ার মতো।
সিয়াম নদীর ধারে অবস্হিত আলংয়ের উচ্চতা হাজার ফুটেরও কম বটে কিন্তু শহরের চেহারা-চরিত্রে বেশ একটা পাহাড়ি শহরের ভাব আছে। প্রকৃতি উপাসক আদি উপজাতির মানুষদের প্রধান উৎসব হলো সোলুং আর মোপিন। প্রথমটি অনুষ্ঠিত হয় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে আর মোপিন উৎসব পালিত হয় এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে।
আলং শহরের এক প্রান্তে বিবেকনগরে অবস্থিত রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির খ্যাতি সমগ্র অরুণাচলজুড়ে। এই আবাসিক বিদ্যালয়টির কর্মযজ্ঞ চাক্ষুষ করা, বিশেষ করে সন্ধের সময় রামকৃষ্ণ মন্দিরে সমবেত প্রার্থনায় উপস্হিত থাকতে পারা এক অমূল্য অভিজ্ঞতা।
আলং শহরের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান হলো জেলা সংগ্রহশালা, ক্রাফট সেন্টার এবং দোয়নিপোলোর মন্দির। শহরের অদূরে সিয়াম ও সিয়াং নদীর সঙ্গমস্থলটিও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা। আলংয়ের বাজারটিও কম আকর্ষণীয় নয়। এখানে সকালের দিকে গেলে দেখা যাবে রকমারি তরিতরকারি আর শাকসবজি নিয়ে বসে আছে উপজাতি নারী-পুরুষ। এদের মধ্যে বেশকিছু সবজি, কন্দ আর ওল সদৃশ কাঁচা আনাজ সমতলবাসীদের অচেনা। বাজারের একদিকে বিক্রি হচ্ছে মিথুনের মাংস আর বড় আকারের মেঠো ইঁদুর। 
পাসিঘাট ঃ
আলং থেকে এবার গন্তব্য পাসিঘাট, দূরত্ব ১০৫ কিলোমিটার। এই পথের অন্যতম আকর্ষণ পথসংলগ্ন কমলালেবুর বাগান। ফলের মরসুমে ফলন্ত গাছ দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে। অরুণাচলের সবচেয়ে পুরনো শহর পাসিঘাটের অবস্থান সিয়াং নদীর ধারে। নদীপথেই পাসিঘাটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল আসামের ডিব্রুগড় শহরের। এই যোগাযোগ আজও বজায় আছে। পাসিঘাটের প্রধান আকর্ষণ অপরূপা সিয়াং নদী। এর উৎপত্তি মানস সরোবরের দক্ষিণ-পূর্বের এক হিমবাহ থেকে। তিব্বতে এই নদী সাংপো নামে পরিচিত। সাংপো নদী ভারতের সীমানায় সমতলে নামার পর সিয়াংয়ের সঙ্গে মিলিত হলো লোহিত, দিবাং, তিরাপ, নোয়াডিহিং এবং আরও কয়েকটি নদী। এদের মিলিত জলধারা পরিচিতি হলো ব্রহ্মপুত্র নামে।
প্রায় দেড় দশক আগে পাসিঘাটে জমজমাট কাঠের ব্যবসা চালু ছিল। সুপ্রিম কোর্টের আদেশে গাছ কাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পাসিঘাটের কাঠের ব্যবসারও ইতি ঘটেছে। পর্যটনশিল্পের হার ধরে পাসিঘাটের লুপ্ত গরিমা আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
পাসিঘাটের দর্শনীয় স্থানগুলো গাড়ি ভাড়া করে বা অটোরিকশায় একবেলাতেই দেখে নেওয়া যায়। দ্রষ্টব্য স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে রানাঘাট ব্রিজ, ডাঙারিয়া শিবমন্দির, দোয়নিপোলোর মন্দির, জেলা সংগ্রহশালা এবং রামকৃষ্ণ মিশন।
পাসিঘাটের অদূরবর্তী ড. ডেরং এরিং অভয়ারণ্যের খ্যাতি প্রধানত স্থানীয় এবং পরিযায়ী পাখিদের জন্য। এছাড়া অন্য প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে বুনো মোষ, সম্বর, বনবিড়াল, শিয়াল এবং বুনো হাতি।
অরুণাচল রাজ্যে জেলার সংখ্যা ২০ টি। 
১. হাওয়াই। ২. চংলং। ৩. সেপ্পা। ৪. পাসিঘাট। ৫. তেজু। ৬. লংডিং। ৭. জিরো। ৮. ইউপিয়া। ৯. তওয়াং। ১০. খোনসা। ১১. রইং। ১২. ইয়ংকিয়ং। ১৩. দপোরিজো। ১৪. বোমডিলা। ১৫. আলং। ১৬. আনিনি। ১৭. কলোরিয়াং। ১৮. নামসাই। ১৯. জমিন। ২০. তাতো।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(CLOSE) #days=(0)

ভ্রমণ করুন, মানসভ্রমণ করান। এখানে টাচ করে দেখে নিন, কীভাবে লেখা মেল করবেন। আপনার ভ্রমণকাহিনী তুলে ধরুন পাঠকের সামনে।
Accept !