ছবির দেশ বাঘাইছড়িতে

লিয়াকত হোসেন খোকন

ছবির দেশ বাঘাইছড়িতে কয়েকবার গিয়েছি। বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে দেখেছি সারি সারি বন উপত্যকার গিরিচূড়া, হ্রদ আর ঝরনা। বসন্ত ঋতুতে বাঘাইছড়িতে নদীতীরে দেখেছি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। উপজাতীয়দের জীবনধারাও দেখেছি নিজ চোখে। পরিচয় হয়েছে চাকমা ছেলে সজীবের সাথে। সজীব চাকমার সাথে এতই আন্তরিকতা গড়ে ওঠে যে-জন্য ওর সঙ্গে প্রতিদিন বিকেলে পাহাড়ের পাদদেশে শুয়ে-বসে কাটাতাম। পাশেই কাসালং নদী - একদিন সকালে দুইজনে নৌকা নিয়ে নদীর ওপারে পাহাড়ে গিয়েছিলাম। এরপর পায়ে হেঁটে কিছুদূর গিয়ে দেখি ঝরনা। ঝরনার জল হাতে নিয়ে সজীবের গায়ে ছিটিয়ে দিতেই ও একটু হেসে গেয়ে উঠল- 'নিটোল পায়ে রিনিক-ঝিনিক পায়েলখানি বাজে/ মাদল বাজে সেই সংকেতে শ্যামা মেয়ে নাচে'- গানের কয়েকটি লাইন।
সজীব চাকমা-ই বলল, এখানকার যেদিকে যাবেন শুধুই শুনতে পাবেন ঝরনার কলকল ধ্বনির শব্দে। একটু আগালেই মাদলের শব্দও কানে এসে ঠেকবে। তখন তো হারিয়ে যেতে মন চাইবে- কি, তাই না? বললাম, হ্যাঁ, তাই তো। এক একসময় বাঘাইছড়ির পাহাড়িয়া সৌন্দর্যে যেন বিমোহিত হয়ে পড়ছিলাম। ওর মুখে শুনেছিলাম, এই বাঘাইছড়িতে বাস করেÑ বম, মুরং, পাংখোয়াই, বনজোগী আর খেয়াং উপজাতিরাও। বমদের ফুলনৃত্য, মুরংদের গোহত্যা নৃত্য বেশ আকর্ষণীয়। সজীব চাকমা হঠাৎ আমার হাতটা ধরে বলল, ওই যে পূর্বে তাকানÑ দেখুন, দেখুন লুসাই পাহাড়। কত নয়নাভিরাম, সৌন্দর্যের রানি যেন লুসাই পাহাড়। তখন দু-নয়ন ভরে বার বার তাকিয়ে রইলাম লুসাই পাহাড়ের পানে। মনে হলো, এ যেন ছবির দেশ। হঠাৎ শুনি মাদল বাজার শব্দ। হ্যাঁ, একটু পরেই দেখি উপজাতি মেয়েরা কলসি নিয়ে নদীর দিকে যাচ্ছে। তখন ওদের দিকে শুধুই যে তাকিয়ে থাকা। ভাবলাম, আমরা আসব বলেই কি ওরা মল বাজিয়ে পথ চলে কিংবা কলসি কাঁখে নদীর তীরে যায়।
বেশ কিছুদূর এগিয়ে চললাম আমরা। একটা জায়গায় এসে সজীব চাকমা বলল, ওই যে পাহাড়টা দেখছেন ওর পাদদেশে কেউ মারা গেলে দাহ করা হয়। আমাদের চাকমা পরিবারের কোনো সদস্য মারা গেলে অত্যন্ত সম্মানের সাথে তার সৎকার করা হয়। মৃত ব্যক্তি আন্দো গোত্রের হলে তাকে সৎকার বা দাহ করার যাবতীয় দায়িত্ব নেয় ভিন্ন গোত্র তথা আরেক গোত্রের লোকেরা। এতে করে তাদের আন্তঃগোত্র সম্পর্ক চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। মৃত ব্যক্তিকে গোসল করিয়ে সাদা কাপড় পরানো হয়...। বললাম, তারপর? সজীব চাকমা দু-চোখের জল মুছে বলল, মৃতদেহ বাঁশের খাটিয়ায় করে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়Ñ দেখুন, এই যে শ্মশান। শ্মশানে আনার পর বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মন্ত্রপাঠ করে। মন্ত্রপাঠ ও যাগযজ্ঞ শেষে মৃতদেহ দাহ করা হয়। ঐ অনুষ্ঠানে সকল গোত্রকে দাওয়াত করে সাধ্য অনুসারে খাওয়ানো হয়। এই শ্মশানে আমার দাদা, দাদু, পিসি এঁরাও রয়েছেন।
আমরা শ্মশান দেখে এরপরে পায়ে হেঁটে চলে এলাম কাসালং নদীতীরে। দেখি সেই মল বাজানো মেয়েরা নদীতে স্নান করছে। ওরা আঞ্চলিক ভাষায় গানও গাইছে। গানের অর্থ না বুঝলেও শুনতে বেশ ভালো লেগেছিল।
নৌকায় বসে সজীব চাকমা তাদের বিবাহোৎসব সম্পর্কে জানাল, চাকমা সমাজে যুবক-যুবতীর বিয়ে একটি স্বীকৃত ও বৈধ বিষয়। তবে আমাদের বিবাহ রীতি অন্য জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় ভিন্ন। আমাদের সমাজে একই গোত্রের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বিয়ে হয় না, যেমনÑ আন্দো গোত্রের ছেলে আন্দো গোত্রের মেয়েকে বিয়ে করতে পারে না। আন্দো গোত্রের ছেলের সাথে সাধারণত, আরেক গোত্রের মেয়ের বিয়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে। যা কিছু হয় তা অভিভাবকের মতামতের ভিত্তিতেই হয়। পিতামাতা তথা অভিভাবকরা ছেলে-মেয়ের বিয়ে ঠিক করার পূর্বে তাদের রাশিচক্রের মিল-অমিল দেখে নেয়। উভয় রাশিচক্র বিপরীতধর্মী হলে বিয়ে হয় না। আমাদের চাকমা সমাজে ছেলে-মেয়েদের প্রেমঘটিত বিয়ে হয় না বললেই চলে। বিয়ের সময় মেয়েপক্ষ বর পক্ষকে যৌতুক হিসেবে অলংকার, মল, হাতি, শূকর ইত্যাদি সাধ্যানুসারে দিয়ে থাকে...।
সজীব চাকমার এ গল্প শুনতে শুনতে আমরা একসময় নদীর ওপারে বাঘাইছড়িতে এসে পৌঁছালাম। বাঘাইছড়ির সজীব চাকমার সাথে খুব ঘনিষ্ঠতা হওয়ায় ও নিজেই বলল, চলুন আমাদের বাড়িতে থাকবেন। দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে ওর পাশে শুয়ে আছি। সজীব বলল, মহামতি বৌদ্ধের প্রতি আমাদের রয়েছে অগাধ শ্রদ্ধা ও ভক্তি। আমাদের নিজস্ব প্রার্থনার ঘর রয়েছে, নাম- 'কেয়াং ঘর'। প্রায় প্রতি বাড়িতে এভাবে কেয়াং ঘর আছে। সব বয়সের নারী-পুরুষ সেখানে গিয়ে প্রার্থনা করে। আমাদের বড়ো উৎসব হলো- আষাঢ়ি পূর্ণিমা, বুদ্ধপূর্ণিমা। ওই সময় এলে বেশ আনন্দ করতে পারবেন। বিজু উৎসবে আমরা নাচগান করি, মদও গিলি...।

বললাম, রাতে কি মদ খাওয়া যাবে? সজীব চাকমা হাসলÑ কেন নয়, মদ খাওয়াব, খাব... বেশ এনজয় হবে। রাত দশটার পরে দুইজনে মদ খেয়ে খেয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যে কী যেন স্বপ্ন মায়ায় বিভোর হয়ে গেলাম। দেখি আমি কাসালং নদীর তীরে বসে আছি। এক চাকমা তরুণী আমার পাশে এসে বসল। হাতটা স্পর্শ করে ওই তরুণী গাইতে শুরু করল- 'আনারের ফুল আজও রাঙা/ চাঁদ আছে অই আধো ভাঙা/ প্রাণে মোর কোন বেদুইন - বলো/ জেগেছে পিয়াসা লয়ে। কোথায় আজও মোর অনামী কিশোর/ এলো মরু পার হয়ে/ শুধু লালে লাল মদ ঢালো।' গানে গানে একসময় চাকমা তরুণী আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। তারপর আমরা কী যেন আনন্দের পরশ খুঁজে পেলাম। এদিকে দেখি ঘুম ভেঙে গেছে...। ভাবলাম, ভূস্বর্গ পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার এই বাঘাইছড়ি ছেড়ে গেলে দু-দণ্ড শান্তি তো পাব না। এ তো স্বর্গরাজ্য। এ যেন একখানা ছবির দেশ - ছবির রাজ্য।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(CLOSE) #days=(0)

ভ্রমণ করুন, মানসভ্রমণ করান। এখানে টাচ করে দেখে নিন, কীভাবে লেখা মেল করবেন। আপনার ভ্রমণকাহিনী তুলে ধরুন পাঠকের সামনে।
Accept !